কপোতাক্ষ, কালিন্দী, কাকশিয়ালী, খোলপেটুয়া, খেজুরদানা, মাউন্দো, মালঞ্চ, ইছামতী, চুনকুড়ি, আড়পাঙ্গাশিয়া, যমুনা, সোনাই, রায়মঙ্গল, মরিচচাপ, বেতনাবিধৌত প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা সুন্দরবনেরই সান্নিধ্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূল। আধুনিক কোনো লোককবির রয়ানে:
‘দেশের সীমানা, নদীর ঠিকানা যেথায় গিয়েছে হারিয়ে,
সেথা সাতক্ষীরা, রূপময় ঘেরা বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।’ প্রাচীনকালে সাতক্ষীরা অঞ্চলকে বাগড়ী, ব্যঘ্রতট, সমতট, যশোর, চূড়ামন প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হতো। খ্রিস্টপূর্বকালে বাংলা অঞ্চলে গড়ে ওঠা গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের ধারণা। তাদের মতে, সাতক্ষীরা অঞ্চলটি ছিল ওই রাজ্যের বন্দর ও বাণিজ্য এলাকা। সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, সুুন্দরবনে কমপক্ষে এক হাজার থেকে বারো শ বছরের পুরনো স্থাপনাগুলোতে ব্যবহূত ইটের বৈশিষ্ট্য ও স্থাপনারীতি পাল আমলের। পাওয়া গেছে বনের গভীরে বসতির চিহ্ন। সুন্দরবনের সাতক্ষীরার শ্যামনগর অংশ থেকে নদীপথে ৮৩ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগর উপকূলের খেজুরদানা, আড়পাঙ্গাশিয়া ও শেখেরটেকে সন্ধান পাওয়া খোলপেটুয়া নদীতীরে ঢেউয়ের তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে মাটির আস্তরণ সরে যাওয়ায় পুরনো এসব স্থাপনা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দক্ষিণবঙ্গের প্রতাপশালী শাসক রাজা প্রতাপাদিত্যের (১৫৬১-১৬১১) রাজধানী ছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকায়। তার বংশের রাজত্ব প্রায় ২৫০ বছর ছিল। মূলত মধ্যযুগেই সাতক্ষীরার অধিকাংশ ধর্মীয় ও সামরিক স্থাপনাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এদের অধিকাংশই টেরাকোটা শিল্পসমৃদ্ধ পুরাকীর্তি হিসেবে পরিকীর্তিত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনার তথ্যমতে, ‘সাতক্ষীরা জেলার মোট ১৪টি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা আঞ্চলিক অফিসের একটি টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে হালনাগাদ জরিপকাজ শেষ করেছে।’ খুলনার সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ নিজ নিজ উপজেলার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ অনুযায়ী প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, হাম্মামখানা, রাজা প্রতাপাদিত্যের আবাসস্থল, জমিদারবাড়ি মাই চম্পার দর্গা, গাজী কালু চম্পাবতীর দর্গা, প্রতাপাদিত্যের গড় ইত্যাদি অবৈধ দখলমুক্ত করে যথা সংরক্ষণ, সংস্কার এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ চলছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ড. মিজানুর রহমানের ‘সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি’ (২০০৮) একটি আকর গ্রন্থ। এ বইয়ে গবেষক মিজানুর রহমান মধ্যযুগের (১১৪৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ) সাতক্ষীরার প্রধান প্রায় ১৮টি স্থাপনার সন্ধান দিয়েছেন। এ ১৮টি স্থাপনার মধ্যে সাতটি শাহি মসজিদ (সুলতানপুর, মুন্সীবাড়ী, বৈকারী, তেঁতুলিয়া, প্রবাজপুর, মৌতলা, টেঙ্গা), ছয়টি মন্দির (শ্যামসুন্দর, দ্বাদশ শিববাড়ী, গোকুলানন্দ, ড্যামরাইল, যশোরেশ্বরী, গোপালপুর), দুটি মাজার (গাজন পীর ও নুরুল্লা খা), দুটি দুর্গ বা হাম্মামখানা (জাহাজঘাটা ও ঈশ্বরীপুর) এবং একটি গির্জা (ঈশ্বরীপুর)।